ফেক নিউজ বা ভুয়ো খবর প্রচার বা মিথ্যা প্রচার , আজকের দিনে সম্ভবত জার্নালিজমের সব থেকে বড়ো সমস্যা। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে ফেক নিউজ ছড়ানো খুবই সহজ । কিন্তু যদি বলি , শুধু আজ নয় প্রায় ২৭০০ বছর আগেও ছিল ফেক নিউজ ? শুনে অবাক হলেন তাই তো ? আজকে ২৭০০ বছরের প্রাচীন একটি রিলিফ ভাস্কর্যের গল্প বলবো । এত বছর ধরে যে মূর্তি মানুষকে ভুল তথ্য পরিবেশন করে আসছে। আসিরিয়ান সভ্যতার (বর্তমানে ইরাকের উত্তর মেসোপটেমিয়ায় একটি প্রাচীন রাজ্য) কিংবদন্তি রাজা আসুরবনীপালের সিংহ শিকারের একটি দৃশ্য নিয়েই মূর্তিটি তৈরি। আপাতভাবে তাতে ভুয়ো খবর বোঝার কিছুই নেই। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে একটি সিংহকে রাজা তাঁর বল্লমের সাহায্যে হত্যা করছেন। রোমান ও আসিরিয় (Assyrian ) সভ্যতায় এমন রেওয়াজ ছিল যে রাজারা যুদ্ধজয়ের পর ফিরে এসে সিংহ হত্যা করে তাঁদের শক্তি প্রদর্শন করতেন । এতে অবাক হবার বা ভুয়ো খবর কিছু নেই।
কিন্তু আসল বিষয়টি যে তা নয়, সেই সন্দেহ তৈরি করে তৎকালীন কিছু সরকারি নথিপত্র । সেই সব নথি এবং দলিল থেকেই ঐতিহাসিকরা জানতে পারেন, রাজা আসুরবনীপালের মৃত্যু হয়েছিল সিংহের আক্রমণেই। না, মূর্তিতে তাঁর সাফল্যের দৃশ্য দেখানো হলেও বাস্তবের রাজা সিংহের কাছে হেরে গিয়েছিলেন। ১৯৩২ সালের গোড়ার দিকে প্রথম একদল উৎসাহী প্রত্নতাত্ত্বিক এই নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। আর এই সময় পপ্রথমবারের জন্য খুঁটিয়ে দেখা হয় মূর্তির আরও নানা দিক। কিন্তু তাতেও রহস্য মিলছিলো না, অর্থাৎ নথির সাথে ভাস্কর্যের মিথ্যার কোনো যোগসূত্র পাওয়া যাচ্ছিলো না। যখন প্রত্নতাত্ত্বিকরা প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন, তখনি হঠাৎ এই নথিতে উল্লেখিত প্রশ্নের উত্তর শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায় একটি অলঙ্কারের মধ্যে। রাজার কানে ঝুলতে থাকা একটি কুণ্ডল।
সাধারণত রাজাদের কানে অলঙ্কার পড়ার চল অনেক কাল থেকেই। তাই এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। কিন্তু একটু খুঁটিয়ে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে আকারে তা মানুষের কানের চেয়ে বেশ কিছুটা বড়ো। আর তার মধ্যেই আছে পাঁচটি তিরের ফলার মতো অংশ। বোঝাই যাচ্ছে ভাস্কর এই কুণ্ডলটি তৈরি করেছেন অতি যত্নে। প্রতিটি ফলার তীক্ষ্ণতা এই ২৭০০ বছর পরেও স্পষ্ট বোঝা যায়। আর সন্দেহ তৈরি হয় সেখানেই। এটি নিশ্চই রাজার প্রকৃত অলঙ্কারের সজ্জা নয়। বরং এর ভিতর দিয়ে কোনো সাংকেতিক বার্তা দেওয়া হয়েছে। এরপর আরো ৩০ বছর কেটে যায়। অবশেষে আসিরিয়ান ধর্মবিশ্বাসের নানা অধ্যায় খুঁজে মেলে সেই সাংকেতিক বার্তার হদিশ। ১৯৬০ সাল নাগাদ ঐতিহাসিকরা একমত হন, রাজা আসুরবনীপাল আসলে সিংহের আক্রমণেই প্রাণ হারিয়েছেন।
ঐতিহাসিকদের মতে, এই দৃশ্য আসলে আরোপিত। তবে বাস্তবের সঙ্গে তার একেবারে সম্পর্ক নেই, এমন নয়। আসিরিয়া তখন রীতিমতো সিংহের উপদ্রবে বিপর্যস্ত। প্রত্যেক অধিবাসী সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকতেন। মানুষ ছাড়াও শিকার বলতে গবাদি পশু তো আছেই। তাই রাজাদের অন্যতম বড়ো সাফল্য হিসাবে বিবেচনা করা হত সিংহের হাত থেকে প্রজাদের রক্ষা করা। রাজা আসুরবনীপালও সেজন্যই সিংহের মুখোমুখি হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর পরাজয়কে ঢেকে ফেলা হয়েছে এক রূপকের সাহায্যে। আর ইঙ্গিত পাওয়া যায় ওই কুণ্ডলে। সেখানে পাঁচটি তিরের ফলার উপস্থিতি আসলে রাজার বারবার ফিরে আসার কথাই বলে। অর্থাৎ সিংহের হাতে মৃত্যু হলেও রাজা বারবার ফিরে এসে সংগ্রাম করে প্রজাদের রক্ষা করবেন । তাহলে দেখলেন তো ফেক নিউজ চিরকালই আছে । তবে ২৭০০ বছরের পুরোনো ফেক নিউজ হিসাবে এটি রীতিমত উচ্চমানের কভার-আপ বলা যায়। তাই চোখ কান খোলা রাখুন, ইন্টারনেট যাই পড়বেন একেবারে দুম করে বিশ্বাস করবেন না। তবে আমরা আশ্বস্ত করতে পারি এই আর্টিকেলটি ফেক নয় Lion Hunt of Ashurbanipal নিয়ে একটু খোঁজা খুঁজি করলেই জানতে পারবেন।